এই নিবন্ধটির একটি সং ক্ষিপ্ততর সংস্করণ ২৯ শে জুন, ২০২১ এর আনন্দবাজার পত্রিকায়, "গুদামে আছে, শিশুর পাতে নেই" শিরোনামে উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল
"খাবার মিলছে না অঙনওয়াডিতে" সংবাদপত্রে ফিরে আসছে শিরোনামটা প্রায় প্রতি মাসেই। ভারতের এমনিতেই বেশ পিছিয়ে থাকা মানবোন্নয়ন সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লজ্জাজনক অবস্থান শিশুদের অপুষ্টির। স্বাভাবিক অবস্থাতেই রাষ্ট্র মোকাবিলা করতে উঠতে পারে না এই সমস্যার। তার ওপর এই অতিমারি যে বাড়তি বোঝা চাপিয়েছে, সেটা সামলাতে যেখানে অনেক বেশী উদ্যমের প্রয়োজন ছিল, সেটা তো দেখা যাচ্ছে না বটেই, উলটে যে টুকু নিয়মিত পাওয়া যেত তাও উধাও!
অপুষ্টির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা একটু দেখে নেওয়া যাক। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৯-২০)র তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ১) ৩৩.৮% (নগর- ৩২.১%, গ্রাম ৩৪%) শিশুর উচ্চতা বয়স অনুপাতে কম (স্টান্টেড), ২) ২০.৩% (নগর -২০.২%, গ্রাম -২০.৪%) ওজন উচ্চতা অনুপাতে কম (ওয়েস্টেড),৩) ৭.১% ( নগর ৭.৯%, গ্রাম - ৬.৯ %) এর উচ্চতা অনুপাতে ওজন অনেক বেশী কম (সিভিয়ারলি ওয়েস্টেড), আর ৪) ৩২.২ % (নগর - ২৮.৭%, গ্রাম - ৩৩.৫%) এর ওজন বয়স অনুপাতে কম (আণ্ডারওয়েট)। এই সার্ভে অনুযায়ী "স্টান্টিং" এর সূচকে উত্তরাখণ্ড, হরিয়াণা, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অসম, ছত্তিশগড়, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ আর বিহারের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে খারাপ। ভারতের গড় ৩৮.৪ % এ রাজ্যের চেয়ে খারাপ। ওয়েস্টিং এ ওডিশা, বিহার, হরিয়াণা, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাট ঝাড়খণ্ড, এবং ভারতের গড় ২১% পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশী। "আণ্ডারওয়েটের ক্ষেত্রেও ভারতের গড় ৩৫.৭% এবং গুজরাট সহ দশটি বড় রাজ্যের অবস্থা খারাপ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে। ২০১৫-১৬ র চতুর্থ পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ১৩টা রাজ্যে স্টান্টিং এর অনুপাত বেড়েছে, আর ১২ টা রাজ্যে ওয়েস্টিং বেড়েছে, ৩ টি রাজ্যে দুটোই বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে স্টান্টিং বেড়েছে ১.৩ দশমিক বিন্দু, ওয়েস্টিং বাড়েনি, কিন্তু আণ্ডারওয়েট শিশু বেড়েছে আগের পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তুলনায় ০.৭ %।
এই পটভূমিকায়, অতিমারির সময়ে শিশুদের পুষ্টির একটু বেশী নজর প্রত্যাশিত ছিল। কিন্ত খবরে দেখছি, আধিকারিকরা জানিয়েছেন এফ সি আই এর খাদ্যশস্য চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না সময় মতো। কেন যাচ্ছে না, সে এক পরম রহস্য, কারণ সরকারের ভাঁড়ারে এতো খাদ্যশস্য আগে কখনো মজুত ছিল না। অসন্তুষ্ট কৃষকদের তুষ্ট করতেই হোক, বা প্রধানমন্ত্রী গরীব কল্যাণ যোজনা রূপায়ণের জন্যই হোক, ২০২১ এর ১ লা মে ১০ কোটি মেট্রিক টন খাদ্য শস্য মজুদ ছিল রাষ্ট্রের ভাঁড়ারে। এই পরিমান ২০২০ র ১লা জুনের ৯.৭০ লক্ষ মেট্রিক টিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আর অতিরিক্ত শস্য গুদামজাত করে রাখার খরচ সব মিলিয়ে প্রায় কিলো প্রতি ৫.৪০ টাকা। অর্থাৎ বিনামূল্যে বিলি করলেও সাশ্রয় হবে সরকারের। স্রেফ লাল ফিতের ফাঁসে এই খাদ্যশস্য আটকে রাখলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর অকারণ ব্যয় বৃদ্ধির দায়ে পড়তে পারেন ভবিষ্যত অডিটে। কিন্তু আরো কয়েকটা বড় রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেরও প্রয়োজন অনুযায়ী অঙনওয়াডির খাদ্যশস্য বাজার থেকে সংগ্রহ করার স্বাধীনতা আছে। সমস্যা কি তবে বাজেট বরাদ্দে। ( How ‘food’ has become the real social safety net in pandemic | Centre for Policy Research (cprindia.org))
২০২১-২২ এ কেন্দ্রীয় সরকার আগের স্কীম গুলো মিলিয়ে জুলিয়ে এখন মোট দুটি স্কিমে নামিয়ে এনেছেন। একটির নাম "সক্ষম অঙ্গনওয়াডি", আর দ্বিতীয়টি "পোষন ২"। এ দুটি স্কিমে ২০২১- ২২ এর কেন্দ্রীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ হয়েছে ২০,১০৫ কোটি টাকা। এই স্কীমগুলির পূর্বসুরী স্কীমগুলোতে আগের বছরে বরাদ্দকৃত টাকা যোগ করে পাচ্ছি ২৪৫৫৭ কোটি টাকা। বেশ কমেছে। Union Budget (indiabudget.gov.in)
আগের বছর ২০১৯-২০তেও নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের ৩৯,৭২২ কোটি টাকা চাহিদা মেটাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২৬১৮৫ কোটি টাকা, চাহিদার ৬৬%। তার পরের বছর দেওয়া হয়েছিল আরো কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল চাহিদার ৬২%। PDF Sample colour file.pmd (rajyasabha.nic.in), 314_2020_3_14.pdf (rajyasabha.nic.in)
সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ জনসংখ্যা অনুযায়ী যতো শিশু থাকার কথা, এবং কেন্দ্রীয় সরকার শিশু ও মা'দের সাপ্লিমেন্টারি নিউট্রিশন জন্য মাথাপিছু যে হারে টাকা বরাদ্দ করেছেন, সেই নিরিখে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, যে রাজ্যগুলি তাঁদের ভাগের সবটাই দিয়েছেন, এটা ধরে নিলেও, দেখা শিশুদের (এবং এই কর্মসূচীর অন্তর্গত মা'দের) পুষ্টির জন্য যতো টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে তা সর্বভারতীয় স্তরে প্রয়োজনের মাত্র ৪৭%. আর পশ্চিম বঙ্গের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের ৫৩%। APIP_2020-21.pdf (icds-wcd.nic.in)
কোভিডের প্রভাব মাপার জন্য ২০১৯-২০ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে পুষ্টির খাতে যত টাকা ছাড়া হয়েছে তার সঙ্গে ২০২০-২১ র এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে ছাড়া টাকার তুলন করলে পাওয়া যাচ্ছে যে সর্বভারতীয় স্তরে ৩% বেশী টাকা দেওয়া হলেও, আগের বারের তুলনায় কম পেয়েছেম এরকম ৯ টি রাজ্য আছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ২৮% টাকা কম পেয়েছেন। Untitled Page (icds-wcd.nic.in)
অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের শিশুদের পৌষ্টিক আহারের জন্য মোট বরাদ্দের ৯৮ % অর্থ ছেড়েছিলেন ২০১৯ এর ডিসেম্বরের মধ্যে, তুলনায় ২০২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁরা ছেড়েছেন মোট বরাদ্দের ৬৪ %। Untitled Page (icds-wcd.nic.in)
পুষ্টি ছাড়াও অঙ্গনওয়াডি গুলির কর্মী ইত্যাদির জন্য যে খাতে টাকা দেন কেন্দ্র, সেই আইসিডিএস (জেনারেল) খাতেও ২০১৯ এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে যে পরিমান টাকা দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার, ২০২০ তে পশ্চিমবঙ্গে তার চেয়ে ২৬ % কম টাকা পেয়েছেন।
বরাদ্দ কৃত খাদ্যশস্য তোলার ক্ষেত্রে ২০১৯ এর অক্টোবর পর্যন্ত ৪৪% তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গ, ২০২০র অক্টোবর অবধিও একই পরিমান উঠেছে। কেরল, গোয়া র মতো কয়েকটি রাজ্য খানিকটা বেশি তুলেছেন ২০২০তে, অন্য দিকে অসম আর বিহার ২০২০তে অক্টোবর অবধি কিছুই তোলেননি। Sales - Food Corporation of India (fci.gov.in)
এই যে বাজেট বরাদ্দ কমছে, কর্মসূচীর তদারকিতেও তার একটা প্রভাব পড়ছে কি? মার্চ ২০২০তে সারা ভারতে মহিলা সুপারভাইজর এবং সিডিপিও পদের ২৮ শতাংশ ফাঁকা ছিল। নারী শিশু কল্যাণ মন্ত্রক তথ্যের অধিকারে আইনে অনুসারে করা একটি প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন ৩০শে জুন, ২০২০ তে, পশ্চিমবঙ্গে ৭০% সুপারভাইজার এবং ৪০% সিডিপিওর পদ ফাঁকা। অন্যান্য অনেক রাজ্যের অবস্থাও একই রকম। যেমন উত্তর প্রদেশে ৫৪% সিডিপিও আর ৫২% সুপারভাইজারের, ত্রিপুরায় ৩৬% সিডিপিও আর ৪২ % সুপারভাইজার, তামিল নাডুতে ৩৪% সিডিপিও আর ৪৩% সুপারভাইজারের পদ ফাঁকা। স্পষ্টতই, আই সি ডি এস কর্মসূচিগুলি তদারকি করার লোকবলই নেই যথেষ্ট সংখ্যায়।
সব মিলিয়ে যে ছবিটা উঠে আসছে, সেটা, কেরল বা গোয়ার মতো গুটিকয়েক রাজ্য বাদ দিল, দেশজুড়ে শিশুদের পুষ্টির সার্বিক অবহেলার। অতিমারী সেটা প্রকটতর করেছে মাত্র।